দেখি নাই ফিরে - (Part-36)

বড়মারা ঘরের বাইরে পা দিয়েছে, সন্ধ্যা হতে এখনো আধাঘন্টা বাকি আছে বলা যেতে পারে গোধূলি, আমরা সবাই ট্রলিতে বসলাম, বড়মা, ছোটোমা, ইসলামভাই ভজু একটা ট্রলিতে আমি নীপা মিত্রা একটা ট্রলিতে ওরা বাইক নিয়ে আগে এগিয়েগেলো। আমরা বড় বিলের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি বড়মাকে বললাম, জানো সকালে এলে এই গ্রামের সব গরুগুলোকে তুমি দেখতে পাবে এই বিলে চড়ছে, বলতে পারো গোচারণ ভূমি। বিলের বুক চিরে নদী গেছে, এখানে একেবারে শুকনো। বিজয় নদীর কাছে এসে বললো মা এইবার একটু নামতে হবে, আমি নদীটা পার করে নিই।
আবার কি জল পেরোতে হবে নাকি রে বিজয়।
না না মা এখান একেবারে শুকনো।
আমি নেমে এলাম।
বড়মা আমার দিকে তাকালো, সকালে এই পথে এলিনা কেনো।
আসলে এক ঘন্টা লাগতো। পারতে, এখান থেকে মোরাম রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছ।
ওর কথা একেবারে বিশ্বাস কোরো না। খালি তাপ্পি।
আমি হাসলাম। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে নদী পার হলাম। সামান্য এক চিলতে জল, এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
হ্যাঁরে অনাদিরা গেলো কোথায়।
ওরা বাইকে যাচ্ছে, তাই ভেতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে চলে গেছে।
ওরা ট্রলি পার করে নিয়েছে, আমরা ট্রলিতে বসলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর বিজয়কে বললাম একটু দাঁড়াতো বিজয়। বিজয় ট্রলি দাঁড় করালো, আমি ট্রলিথেকে নামলাম। বড়মার ট্রলির দিকে এগিয়ে গেলাম। নীপা মিত্রাকে কিছু বললো, দুজনেই আমার কাছে চলে এলো।
কি হলো
সকাল বেলা এই বোনটা তোমায় দেখিয়েছিলাম, মনে পরে।
শ্মশান।
হ্যাঁ।
তখন কতো দূরে মনে হচ্ছিল।
মোরামরাস্তা এখনো অনেক দূর। ওই দেখা যায়। দেখো তিনটে বাইক দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পাচ্ছ।
হ্যাঁ।
এই শরু আইল পথ গিয়ে শ্মশানে মিশেছে। ফেরার পথে যাবে নাকি।
যাবো। বড়মা মাথায় হাত দিয়ে প্রণাম করলেন, দেখা দেখি ছোটোমা মিত্রা নীপা এমনকি ইসলামভাই প্রণাম করলো।
আমরা সবাই আবার ট্রলিতে উঠলাম, পীরসাহেবের থানে যখন পৌঁছলাম, চারিদিকে আলো নিভে গেছে। ট্রলিথেকে নেমে সঞ্জুকে দেখতে পেলাম। এগিয়ে এলো।
কিরে তুই এখানে।
একগাল হাসি।
সকাল থেকে তোর কোনো পাত্তা নেই ব্যাপার কি।
চিকনার দিকে তাকালো। চিকনা তোকে কিছু বলে নি।
বলেছে। যা বলেছে তাতে তোর এখানে থাকার কথা নয়। বুঝেছি নিউজটা তোর কাছে আসতে গিয়ে মাঝে ব্রেক করে আর এক জায়গায় চলে গেছে।
বড়মা তোকে ডাকছে। অনাদি বললো। আমি বড়মার দিকে তাকালাম, পাঁচজনে কিছু শলাপরামর্শ করছে। দূরে একটা বাইক তীর বেগে ছুটে আসছে, তার আলোটা একবার রাস্তার ওপর আছাড় খাচ্ছে আর একবার দূরে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে।

আমি পায়ে পায়ে বড়মার দিকে এগিয়ে গেলাম, চারদিকে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। তার রূপলি আলোর ছটা চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে। আমি বড়মার কাছে এলাম, বড়মার চোখের ভাষা আমি পরতে পারছি না।
যাবি না।
চলো।
আমি আগে আমার একপাশে বড়মা একপাশে মিত্রা পছনে ইসলামভাই নীপা ছোটোমা ভজু। তার পেছনে অনাদিরা। আমরা সেই বড় অশ্বত্থ তলায় এলাম, পুকুরের জল শুকিয়ে গেছে, মাঝে কিছুটা রয়েছে।
জানো বড়মা এই পুকুরের জল আমি কোনোদিন শুকোতে দেখিনি। অনাদিদের জিজ্ঞাসা করো। এ তল্লাটের সব পুকুরের জল শুকিয়ে পুকুর ফেটে চৌচির হয়ে যায়, কিন্তু এই পুকুরের জল তুমি এখন যেমন দেখছো তেমনি থাকবে, বর্ষাকালে অবশ্য ভরে যায়।
দিদিগো আমি এসেগেছি।
নিরঞ্জনদার গলা না।
হ্যাঁ।
আমরা এখানে জানলো কি করে।
বাড়িতে গেছিলো ওরা বলেছে।
পেছনে পচাকে দেখতে পেলাম।
কিরে পেচো। সকাল থেকে পাত্তা নেই, নিরঞ্জনদাকে কোথা থেকে ধরে আনলি।
কেনো চক থেকে। আমি তো চকে বসেছিলাম। আমার তো ওখানে ডিউটি ছিল। অনাদি তোকে কিছু বলে নি।
আমি ঠিক সময় এসে গেছি দিদি অন্যায় নিও না পার্টিকরা কি যে ফ্যাচাং।
মিত্রা আমার একটা হাত ধরে আছে। ওর হাতটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। বড়মা আমার আর একটা হাত ধরে আছে। মুন্নাভাই এই ঘাসের ওপরে সকলে বোসো। একদিন এই গাছটার তলায় আমার বাবা একজন ফর্সা মতো লোককে দেখতে পেয়েছিলেন, তার সাদা ধবধবে দাড়ি পরনে সাদা আলখোল্লা। এই গ্রামের মানুষের মুখে মুখে যেটা বহু দিন ধরে প্রচলিত হয়ে চলে আসছে, একদিন হয়তো আমার মুখের কথায় আরো একজন অনি এসে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করবে, পাবে কিনা বলতে পারবে না। তবে গাছটার ডাল পালা কেউ কাটে না। ঝড়ে ভেঙে পরতে দেখেছি। শুনেছি, দেখিনি এর ডালে কুরোঠের কোপ মারলে তার মৃত্যু হয়েছে। আমি প্রায় এখানে আসতাম। যখন গ্রামে থাকতাম। এখনো গ্রামে পা রাখলে একবার অন্ততঃ আসবো। দেখতে পাচ্ছ চারিদিক, তিন কিলোমিটার ব্যাসার্দ্ধের মধ্যে এই স্কুলটা ছাড়া কোনো জনমানব নেই। আমি অমাবস্যার রাতে একা এখানে আসি। ভীষণ ভালো লাগে, তোমাকে বোঝাতে পারবো না, পুকুরের ওই পাড়টায় বসে থাকি ঘন্টাখানেক, তারপর চলে যাই। এখানে এলে আমি নিজের মধ্যে নিজে থাকি না। আমার বিপদে আপদে এই গাছটা আমায় ভীষণ সাহায্য করে, তোমরা বিশ্বাস করতে পারো আবার নাও করতে পারো। আমার যা কিছু চাওয়া পাওয়া এই গাছের কাছে।



ইসলামভাই আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমার হাতটা ধরে বললো, আজ আমি এখানে তোর জন্য নমাজ পরবো, তারপর তোর কাছ থেকে কিছু চাইবো, তুই দিবি।
আমার ক্ষমতা সীমিত, আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যদি থাকে তোমাকে অবশ্যই দেবো।
সঞ্জু ফুল নিয়ে এসেছিস বাবা।
হ্যাঁ বড়মা।
আমার পাশে মিত্রা দাঁড়িয়ে আছে আমার হাতটা ধরে। ও আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, ওরা সবাই পুকুর ঘাটে নেমে গেলো। যে যার মতো করে হাত-পা ধুলো মুখে-হাতে জল দিলো। গাছের তলায় সবাই একসঙ্গে বসলো। ইসলামভাই তার মতো নমাজ পরতে শুরু করলো। আমি মিত্রা দুজনে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। চল আমরা পুকুর ঘাটে যাই। মিত্রার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোলো না। জুতো খুলে, দুজনে পুকুর ঘাটে নামলাম। ভালো করে হাতে-মুখে জল দিলাম।
ভয় করছে।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের ইশারায় কথা বললো, না।
আমরা উঠে এলাম। দেখলাম ওরা দাঁড়িয়ে আছে। বড়মা এগিয়ে এলেন। গাছের তলায় ফুলের পাহার, ওরা যে যার মতো অঞ্জলি দিয়েছে। আমার বিশ্বাসে ওরাও সামিল হয়েছে। বড়মা আঁচলের গিঁট খুললো। একটা মলিন সোনার চেন গিঁটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো, চিন্তে পারলাম এটা মায়ের গলার চেন, একদিন নিভৃতে একাকি ঘরে মিত্রার গলায় পরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, সেদিন মিত্রা আমার হাত থেকে ওটা পরতে চায় নি। বলেছিলো ওটা রেখে দে আমি সময় হলে তোর কাছ থেকে পরবো, আমায় কথা দে এই হার তুই কাউকে দিবি না। ওটাতে আমার অধিকার। আমি কথা দিয়েছিলাম।
আমি বড়মার মুখের দিকে তাকালাম, বড়মার চোখ দুটো ছলছলে। চোখে কিসের আর্তি। ইসলামভাই আমার কাছে এগিয়ে এলো আমার হাতটা ধরলো, নিরঞ্জনদা এগিয়ে এলো, ছোটোমা তার পাশে, একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি কোনো কথা বললাম না কেমন যেনো হয়ে গেলাম, আমি বড়মার হাত থেকে হারটা নিয়ে মিত্রার গলায় পরিয়ে দিলাম। আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছি, মিত্রার হাত ধরে সেই অশ্বত্থ তলায় নিয়ে গিয়ে একসঙ্গে প্রণাম করলাম, গাছের গোড়ায় রাখা ফুলের থেকে একমুঠো ফুল নিয়ে মিত্রার হাতে দিলাম, তারপর মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। কেনো জানি না।
বড়মা এগিয়ে এলন, আমি মিত্রাকে ছেড়ে বড়মার বুকে মুখ লোকালাম। ছোটোমা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ইসলামভাই নিরঞ্জনদা পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা ছজন আমাদের থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

মুখ তোল অনি। কাঁদিস না। আমি তোর মুখ দেখিনি তোর বুকটা দেখেছিলাম। আমি যে তোর মা। আমার আগে তোর ছোটোমা তোর বুকটা দেখেছিলো।
আমার কান্না থামছে না। মার কথা বার বার মনে পরে যাচ্ছে, চোখ বন্ধ করেও তাকে দেখতে পাচ্ছি না।
অনি জানিস তো বিয়েটা একটা উপলক্ষ মাত্র, ভালোবাসার বন্ধন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন্ধন। যে কথা তোকে এতদিন বলিনি, সেই কথা তোকে আজ বলি, আমি বড়মার কাঁধে মুখ গুঁজে না না বলছি। তোকে শুনতে হবে অনি, বড়মা তোর কাছে কনফেস করবে বলেছিলো।
তোর দাদার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় নি। কিন্তু ভালোবাসার অধিকারে, তার সঙ্গে তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলাম, আমাদের ভালোবাসায় কোনোদিন চির ধরে নি। আমার বাবা বসিরহাটের বিশাল জমিদার, কলকাতায় এক আত্মীয় বাড়িতে থেকে বিদ্যাসাগর কলেজে পরি, কলকাতা তখন উত্তাল, সত্তরের দশক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়, দুজনে এক কলেজে পরতাম, তোর দাদা আমার থেকে একবছরের সিনিয়ার, চুটিয়ে পার্টি করে কলেজের জিএস, নিরঞ্জন আমার থেকে একবছরের জুনিয়র, তোর দাদার থেকে দুবছরের। ও তোর দাদার সাকরেদ, বিয়ের রাতে তোর দাদা নিরঞ্জনকে পাঠিয়েছিলো, একটা চিরকুট, বিয়ে হওয়ার পর বাসর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম বাথরুম যাওয়ার নাম করে, তারপর তোর দাদার হাত ধরে কলকাতায়, এসে নিরঞ্জনের মেসে ছিলাম একমাস। তখন থেকে ও আমার ভাই, আমি ওর দিদি, অনেক ঝড় ভাইবোনে কাটিয়েছি, তোর দাদা তার আঁচও পায় নি। পেতে দিই নি। তাহলে তোর দাদাকে আজ হয়তো পেতিস না। অনেক বার তোকে বলতে চেয়েছি পারি নি, মনে মনে ঠিক করেছিলাম, তোর বিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে তোকে সব কথা বলবো। নিরঞ্জনকে তাই আজ ডেকে নিয়েছি, তোর দাদার খুব আসার ইচ্ছে ছিলো, পারে নি তাই নিরঞ্জনকে সাক্ষী মানলাম।
সেদিন সেই রাতে কলকাতায় আসতে আসতে তোর দাদার কাছ থেকে দুটো কথা আদায় করেছিলাম, যে আমায় সিঁথিতে সিঁদুর পড়িয়ে দিয়েছে, তার তো কোনো দোষ নেই, তার জন্য এই সিঁদুরটা থাক, তোমার জন্য আমার ভালোবাসা রইলো, আর একটা কথা তোর দাদার কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে ছিলাম, আমাকে কোনো দিন মা হতে অনুরোধ করবে না, তখন বয়েসটা কম ছিলো, একটা আবেগের তাড়নায় বলে ফেলেছিলাম, আজ বুঝতে পারি কতো বড় ভুল করেছিলাম।
আমার হাত দুটো ধরে বললো বুড়ীমাসির কাছে আমি সব খোঁজ নিয়ে মিত্রাকে তোর হাতে আজ সঁপে দিলাম। ওরও একটা জীবন আছে। আমি তোকে আমার মতো প্রতিজ্ঞা করতে বারন করবো, মিত্রা তোকে ভালোবাসে, তুই মিত্রাকে ভালোবাসিস। তোদের ভালোবাসর ফল আমাদের দিস, আমরা মানুষ করবো, তোরা দুটোতে যেমন আছিস তেমন থাকিস, তোর বড়মার আগে ছোটোমা সব জেনেছে মিত্রার কাছ থেকে, মিত্রা কোনো কথা অস্বীকার করে নি, আমি তোর দাদার মতামত নিয়েছি, সে আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, মিত্রার বাবা চেয়েছিলো তোকে, তার মা চায় নি, আজ মিত্রা তোকে চাইছে। তোর বড়মা ডাকাবুকো, সহজ সরল বড়মার পেছনে একজন বিদ্রোহিনী লুকিয়ে আছে, একদিন আবিষ্কার করলাম আমি তোর মধ্যে তোর দাদাকে খুঁজে পাচ্ছি, বরং একটু বেশি, আমি তোর দাদাকে তোর মতো দেখতে চেয়েছিলাম, পারি নি। তোর ছোটোমারও একি অবস্থা আমার মতো। তবে.......।
আমি বড়মার মুখ চেপে ধরলাম, ঘার দুলিয়ে না না করছি। ছোটোমাকে জরিয়ে ধরলাম। কিছু বলতে গেলো, আমি ছোটোমার মুখ চেপে ধরলাম, মিত্রা পাসে এসে দাঁড়ালো, বুবুন তুই কাঁদিস না। তোকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি, এর থেকেও তুই অনেক বড় বড় ব্যাপার সামলেছিস, আমি কেঁদেছি, তুই শক্ত থেকেছিস। তুই আমার কথাটা একবার ভাব। আমারও তোর কাছে কিছু চাওয়ার আছে। আমি ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি, মিত্রাও ছোটোমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমি সামনে মিত্রা পেছনে। ছোটোমাও কাঁদছে। শেষপযর্ন্ত ছোটোমা বলে উঠলো তোদের দুজনার চাপে আমিতো দমবন্ধ হয়ে মরে যাবো।

বড়মা আবার বলতে শুরু করলো, ছোটোমার কথা একবার ভাব, কত কষ্ট বুকে নিয়ে বসে আছে, তুই ভাবচ্ছিস নিরঞ্জন কিছু জানে না, নিরঞ্জন সব জানে, মুন্নার ব্যাপারটাও। তোর ছোটোমা গাড়িতে আসতে আসতে সব কনফেস করেছে নিরঞ্জনের কাছে, তোর দাদা নিরঞ্জনকে সব বলেছে, ওরে ও যে আমাদের ঘরের লোক।
নিরঞ্জনদা আমার কাছে এগিয়ে এলো, নারে অনি তুই ঠিক করেছিস, তোর ডিসিসন পারফেক্ট ডিসিসন, তোর জায়গায় আমি থাকলেও তাই করতাম, আমি তোকে ঠিকমতো চিনি না তুই আমাকে ঠিক মতো চিনিস না, কেনো তুই ওপেন করবি নিজেকে, আগে দুজনের বোঝা-পরার পালা শেষ হোক, তাই না।
আমি নিরঞ্জনদার দিকে তাকালাম। তুই সত্যি আমাদের গর্ব, দাদাকে জিজ্ঞাসা করিস, নারসিংহোমে তোকে দেখেই আমি দাদাকে বলেছিলাম, রাইজিং সান খুব সাবধানে অপারেট কোরো, নাহলে পুরে ছাই হয়ে যাবে। দাদা মাঝে মাঝে আমার কথা শোনে, এই কথাটা রেখেছিলো। ছোটো ওটা দেতো, এই ফাঁকে পরিয়ে দিই।
ছোটোমা নীপাকে ডাকলো, নীপার ব্যাগ থেকে একটা অরনামেন্টের বাক্স বার করে নিরঞ্জনদার হাতে দিলো। নিরঞ্জনদা বললো দে মিত্রাকে পরিয়ে দে। আমি মিত্রাকে পরিয়ে দিলাম। আমি মিত্রা নিরঞ্জনদাকে প্রণাম করলাম।
বুঝলি অনি আমি এখনো কুমার থেকে গেলাম, তোর বড়মা ছোটোমাকে বলে বলে আমার মুখটা একেবারে হেজে গেছে, দেখতো মিত্রার মতো একটা মেয়ে খুঁজে পাস কিনা, তাহলে এই বুড়ো বয়সে একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসি।
মরন, রস দেখো না। বড়মা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো। সবাই হেসে উঠলো। আমিও না হেসে পারলাম না।
ইসলামভাই এসে বললো, মনে কিছু করিসনা অনি, আমি এখানে এসে সব জানলাম, এই প্লেনটা বহু দিন থেকে চলছে, এরা সবাই জানে, তোর বন্ধুরা আজ জেনেছে, বড়মা ওদের সব বলেছে, বিশ্বস্ততার সঙ্গে ওরা তা পালন করেছে, এমনকি বাজারে গিয়ে আমি ওদের সঙ্গে কত গল্প করলাম, তাও জানতে পারি নি, ওরা ঠিক তোর মতো তৈরি হয়েছে, বাসুর দোকানে যখন জামাকাপর কিনলাম, ও খালি জিজ্ঞাসা করেছিলো কার জন্য, আমি ওকে বলেছিলাম, বাকিটা ও গুছিয়ে দিয়েছে। আমরা আসার আগে এখানে সঞ্জু সব পৌঁছে দিয়েছে, তোর চোখে মুখে সন্দেহের ছাপ দেখেছি, কিন্তু তুই যে বুঝতে পারিস নি, তা জানি। তোকে এই মুহূর্তে আমার দেবার মতো কিছু নেই, তুই এখানে অনেক বড়ো কাজ করার জন্য এসেছিস, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি, এটা রাখ কাজে লাগবে, ইসলামভাই পকেট থেকে একটা হাজার টাকার বান্ডিল বার করলো, আমি হাতে নিলাম, তারপর ইসলামভাইকে বললাম এটা তোমার কাছে রাখো, প্রয়োজনে চেয়ে নেবো।
ভুলে যাবি না।
হেসেফেললাম ইসলামভাইএর বুকে মাথা গুঁজলাম। মিত্রা ইসলামভাইকে এই ফাঁকে প্রণাম করলো। ইসলামভাই আমাকে ছেড়ে মিত্রাকে কাছে টেনে নিলো। দুই কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে বললো, ইসলামভাই তোর প্রণাম নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে নি। তোর প্রতি অনেক অন্যায় অবিচার হয়েছে, ইসলামভাই এবার সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবে, তোকে কথা দিচ্ছি তোর চোখের জল বৃথা যায় নি যাবে না। ইসলামভাই মিত্রার কপালে চুমু খেলো।
ওরা সবাই কিছুনা কিছু নিয়ে এসে ছিলো, নীপাও নিয়ে এসেছিলো। সবাই একে একে মিত্রার হাতে তুলে দিলো। অনাদি আমার কাছে এগিয়ে এলো। ওর পেছন পেছন বাসু সঞ্জু চিকনা পচা। তোর কাছ থেকে আজ একটা জিনিষ শিখলাম, কাউকে বিশ্বাস করবি না, বিশ্বাস করার যোগ্যতা অর্জন করলেই তারপর বিশ্বাস কর, চোখটা আজ খুলে গেলো, তোকে কথা দিলাম, তুই আমাদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিস তা যত কষ্টই হোক সফল করবো। এটা তুই রাখ, এটাই তোর সেরা অস্ত্র। এটা দিয়ে তুই একাট লোককে বাঁচাতে পারিস, আবার একটা লোককে নির্দিধায় খুন করে দিতে পারিস, অনাদি আমার হাতে একটা পার্কার পেন তুলে দিলো। আমি হেসেফেললাম।

শেষে ভজুরাম দুটো অশ্বত্থ পাতা তুলে এনে আমার হাতে একটা আর মিত্রার হাতে একটা দিয়ে বললো, অনিদা তুমি যে বলেছিলে কোনোদিন বিয়ে করবে না, তাহলে এটা কি হলো।
আমি হাসলাম, বিয়ে করলাম কোথায় তোর দিদিমনির সঙ্গে একসঙ্গে থাকার অধিকার অর্জন করলাম।
ও। বিয়ে না।
না।
তাই সিঁদুর পরালে না। না।
হ্যাঁ।
ভজু হাঁটতে হাঁটতে আপন মনে পুকুরের ওপারে ট্রলির দিকে চলে গেলো। আকাশের দিকে তাকালাম অশ্বত্থ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে গাছের তলায় পরেছে। চারিদিকে আলোয় আলো, কি ঘটলো ব্যাপারটা, সত্যি কি এটা বিয়ে না ভালবাসার মিলন। পৃথিবীতে কোনটা সত্য বিয়ে না ভালোবাসা। বিয়ের মৃত্যু হয়, ভালোবাসার কোনো মৃত্যু নেই, নেই তার কোনো কেমেস্ট্রি। কোনো বৈজ্ঞানিক আজ পযর্ন্ত এর ব্যাখ্যা সঠিক ভাবে দিতে পারে নি। বড়মা এটা কি করতে চাইলো। বেঁচে থাকা, আশা, হোপ। মিত্রার ফোনটা বেজে উঠলো। মিত্রা নম্বরটা দেখে বড়মার হাতে এগিয়ে দিলো। দাদার গলা। ভয়েজ অন করা আছে।
কাজ শেষ হলো।
হ্যাঁ।
কোনো ঝামেলা করে নি তো।
না।
ওটা নিয়েই আমার একটু টেনসন ছিলো। বড্ড মুডি।
ও সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দাও দাও।
বড়মা আমার হাতে ফোনটা দিলো।
তোর কাজ ঠিক ঠিক করে দিয়েছি।
তাই।
কালকের কাগজটা দেখিস। সব এডিসনেই ফার্স্ট পেজটা চেঞ্জ করলাম না, ভাতরের পেজ গুলো এ্যাডিসন অল্টারেসন করলাম। তারপর বল।
তুমি বলবে আমি আজ শুনবো।
কেনোরে আমি কি করলাম, আমি বলবো আর তুই শুনবি। এতকাল তুই বললি আমি শুনলাম। আজ আবার কি হলো।
কি করো নি।
আমি কিছু করিনি, তোর বড়মা আর মল্লিক।
বড়মা আর মল্লিকদাকে প্লেনটা কে দিয়েছিলো।
সেটা তুই বলতে পারিস, জানিস নিরঞ্জনকে তোর ব্যাপারটা যখন খোলাখুলি বলি ও আমাকে সাবধান করলো, বললো তুই নাকি রাইজিং সান, আমি পুরে যেতে পারি, শেষে ডক্তার যখন বললো বুঝলে এডিটর খাঁটি ইস্পাত খুব সাবধান, হাত কেটে যেতে পারে। তখনই তোর বড়মাকে বলে ব্যাপারটা ঠিক করলাম।
তুমি আমার কথা এতটা ভাবো।
দূর পাগল মন খারাপ করিস না, মানুষের বুক আর মুখ এক নয়, তুই তো আমার মুখ দেখেছিস, বুকটা দেখার চেষ্টা করিস নি। দে দে তোর বড়মাকে দে।
আমি বড়মার হাতে ফোনটা তুলে দিলাম।
আমারটা ওকে দিয়েছো।
না বাড়িতে গিয়ে দেবো।
ঠিক আছে ঠিক আছে। এইবারে মরন বললে নাতো।
যাঃ।
একবার মরন বলো। তোমার মুখে মরন কথাটা শুনতে দারুন লাগে।
ধ্যুস।
প্লিজ প্লিজ।
মরন।
থ্যাঙ্ক ইউ।
বড়মার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পরলো।
আমি বড়মার আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। বড়মা ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মিত্রার ফোনটা আবার বেজে উঠলো। বড়মা বললেন তোর সাথে কথা বলতে চায়, আমায় ফোনটা দিলেন।
দেখলাম মল্লিকদা। রিসিভ করলাম।
কি গুরু পাটালি, জিলিপি একলাই খাবে।
কোথায় খেলাম।
তারমানে।
সঙ্গে সঙ্গে অনাদি চেঁচিয়ে উঠলো সত্যি তো, পচা নিয়ে আয় নিয়ে আয়। বিজয়ের ব্যাগে আছে। ওদেরও ডেকে আনিস।
কি রে চেঁচা মিচি কিসের।
এখন সবার মনে পরেছে।

সত্যি তোর ছোটোমাটা একটা ঘটত্কচ।
কেনো।
পই পই করে বললাম, ওটা অনির ফাবারিট জিনিষ।
আমি ছোটোমার দিকে তাকালাম। ছোটোমা মুচকি মুচকি হাসছে।
তা গুরু কিরকম খেললাম বলো।
আমি একটা গোল খেলে দুটো দিই।
সে হবে না, এখন আমরা দলে ভারি, পাঁচজন, তুই একা। লড়তে পারবি না। বড়ে দিয়ে তোকে কিস্তি মাত করে দেবো।
বুঝেছি।
আমার জন্য একটু পাটালি আর জিলিপি নিয়ে আসিস।
হবে না।
কেনো।
যার জন্য স্কীম করেছো, সে সব খেয়ে নেবে।
না গো মল্লিকদা, মিথ্যে কথা বলছে। মিত্রা বললো।
কিরে ভয়েজ অন নাকি।
হ্যাঁ। এটাও তো তোমার স্কিম।
যাঃ কি যে বলিস। আছে নাকি ধারে কাছে।
থাকবে না মানে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
ছোটোমা চোখের ইশারায় না বলছে, আমি ভয়েজ অফ করে ছোটোমার হাতে দিলাম। ছোটোমা মল্লিকদার সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলো। ওরা জিলিপি, পাটালি নিয়ে এসেছে, বার করার আগেই মিত্রা গিয়ে খাবলা মারলো। একটা নিয়ে এসে বড়মাকে হাঁ করতে বলে মুখে পুরে দিলো। আরএকটা নিয়ে ছোটোমার মুখে তারপর নিরঞ্জনদার মুখে তারপর ইসলামভাই-এর মুখে গুঁজে দিয়ে, আবার ছুটে চলে গেলো খাবলা মারতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, চলে আয় না হলে এখুনি শেষ হয়ে যাবে।
হাসলাম।
তুই এনে দে। বড়মা বললো।
বয়ে গেছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
সে কি রে।
তুমি রাখোতো, আগে নিজে প্রাণ ভরে খাই তারপর। ও অনেক খেয়েছে, না খেলেও চলবে। বাসু বুবুনের ভাগটা আমায় দিয়ে যাও।
বাসু হাসছে। একটা পাটালির টুকরো আর জিলিপি আমায় দিলো। মিত্রা আমার কাছে এগিয়ে এলো। তেলভাত খেয়েছিস দুপুরে খাস নি, বদ হজম হবে।
বড়মা আর হাসি চাপতে পারলো না, হো হো করে হেসে উঠলো।
মল্লিকদা নিশ্চই কিছু বলেছে, তাই ছোটোমা বললো আবার কে মিত্রা। সেই কাল রাত থেকে শুরু করেছে।
বাসু সবাইকে হাতে হাতে এসে দিয়ে গেলো।
নিরঞ্জনদা, ইসলামভাই হাসছে।
ওদিকে সঞ্জু আর চিকনার মধ্যে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়, পচা সামলাচ্ছে।
মিত্রা ওদের দিকে এগিয়ে গেলো, পচা চেঁচিয়ে উঠলো,ম্যাডাম আপনি আসবেন না যতক্ষণ থাকবে চলবে, শেষ হলে থেমে যাবে।
আর নেই।
পচা বিস্মিত হয়ে বলে ফেললো, আরো লাগবে।
থাকলে ভালো হতো।
খেমা দেন, কাল সকালে এনে দেবো।
পচার কথায় আমরা হাসাহাসি করছি, নীপা মিত্রাকে সাহায্য করছে কারাকারির জন্য।
বাসু ছোটোমার হাতে দিলো, ভজু এসব দেখে একবার নাচে একবার হাসে, আমার কাছে এসে বলে গেলো, অনিদা জিলিপির থেকে পাটালিটা দারুন। আমি ভজুর মাথায় একটা চাঁটি মারলাম।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো শেষে মিত্রা নীপা দুজনে মিলে পাতা চেটে তার রস খেলো, তারপর নেমে গেলে পুকুরে হাত ধুতে, আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, ওরা সবাই গিয়ে ট্রলিতে বসলো, আমি মিত্রার কানে কানে বললাম, এখানে দাঁড়িয়ে কিছু চেয়ে নে পেয়ে যাবি।
ও আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে উত্তর দিলো, আমি নীচু হয়ে একটু মাটির গুঁড়ো তুলে ওর কপালে টিপ পরিয়ে দিলাম।
সবাই এগিয়ে চললাম, পেছনে আজকের এই মিলনের স্বাক্ষী থাকলো পীরবাবার থান।

রাস্তায় হৈ হৈ করতে করতে সবাই বাড়ি চলে এলাম। আসার সময় নিরঞ্জনদাকে বললাম, রাতে একবার তোমার সঙ্গে বসবো, একটু দরকার আছে।
নিরঞ্জনদা বললো ঠিক আছে।
বাড়িতে আজ চারিদিকে লাইট জলছে। সঞ্জু কথা রেখেছে। আমি ঢোকার সময় কাকাকে প্রণাম করে সব বললাম, মিত্রা পাশে দাঁড়িয়েছিলো। কাকা হাসতে হাসতে বললো, তোর বড়মা যাওয়ার সময় সব বলে গেলো, আমি গেলে তুই যদি বুঝতে পারিস তাই নিয়ে গেলো না। আজ খুব তোর বাবা-মার কথা মনে পরছে রে। কাকার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। যা ভেতরে যা। আমি ভেতরে এলাম, দেখলাম রান্নার আয়োজন খুব একটা খারাপ নয়, লতা কাঞ্চন পাঁচু রান্নাঘরে কাকীমা সুরমাসিকে সাহায্য করছে। আমি দেখে হেসে ফেললাম। প্রিপ্ল্যান্ড সব ব্যাপার। খালি আমি বুঝতে পারলাম না। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে, বল কিরকম দিলাম তোকে।
রাতে আমার কাছে থাকবি এটা মনে রাখিস। শুদে আসলে তুলে নেবো।
মিত্রা নিঃশব্দে আমার কোমরে চিমটি কাটলো।
আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সহ্য করলাম, কোনো আওয়াজ করলাম না।
মিত্রা দাঁত চিপে বললো ছোটোমা দেখছে।
আমি ছোটোমার দিকে তাকাতেই ছোটোমা হেসেফেললো।
খিদে পাচ্ছে।
সব্বনাশ।
মিত্রা ছুটে গিয়ে বড়মাকে হির হির করে টেনে আনলো।
ওরে কি বলবি তো বয়স হয়েছে কোথায় পরে মরবো।
আমার কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করালো।
বল।
কি বলবো।
এই যে এখুনি বললি।
খিদে পেয়েছে।
শুনলে তোমার ছেলের কথা। কানটা ঠিক আছে তো।
ছোটোমা এগিয়ে এলো।
তুই ওরকম ঝগড়া করছিস কেনো।
ছোটোমাকে একবার শুনিয়ে দে।
বড়মা হাসছে। কোনো কথা বলতে পারছে না।
মিত্রা বললে রাক্ষুসী, অনি বললে রাক্ষস হয় না, তাই না। ওর তো কোনো দিন খিদে পায় না। হাওয়া খেয়ে থাকে।
ছোটোমা এবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে, হাসতে হাসতে মাটির সঙ্গে মিশে যাবার দশা।
নীপা চারটে রসগোল্লা নিয়ে এলো প্লেটে করে।
একবারে দিবি না। আগে আমার জন্য আন, তারপর।
আচ্ছা আচ্ছা তোকে দিচ্ছে।
না আগে আনুক তারপর ও খাবে।
আমার প্লেট থেকে একটা নিয়ে মুখে পুরে দিলো।
নীপা আসার আগেই তিনটে সাবার।
কিগো অনিদা এরি মধ্যে। মিত্রার দিকে তাকিয়ে। কথা বলো না রসগোল্লার রসে বিষম লেগে যাবে।
খাওয়া শেষ করে নীপার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে কঁত কঁত করে জল খেলো। ওঃ কিছুটা কমলো।
কি কমলো। ছোটোমা বললো।
যা খিদে পেয়েছিলো।

বড়মা ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে, এবার শান্তি।
শান্তি মানে, .......বুবুন কিছু বলে না। বড়ো ভালো ছেলে।
এবার তোর কান ধরবো।
মিত্রা কানটা বারিয়ে দিলো।
ইসলামভাই, নিরঞ্জনদা ওকে দেখে হাসাহাসি করছে।
আমি ও বাড়িতে গেলাম, দেখলাম বারান্দায় অনেক লোকের ভিড়, সবাই নিরঞ্জনদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। নিরঞ্জনদা কাউকে নিরাশ করছে না সবাইকে বসতে বলে গেছে। আমি ওপরে উঠে গেলাম। লাইটটা জালালাম, অনাদিরা কিছুক্ষণ পর এলো, এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তুই বিশ্বাস কর অনি। দুপুরের পর থেকে সব কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
কেনো।
খাওয়ার পর বড়মা আমাদের তিনজনকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন, আগে তিনজনকে শপথ বাক্য পাঠ করালেন, তারপর সব বললেন। বিশ্বাস কর অনি বড়মার কথা শোনার পর, কালকে থেকে যে ক্লান্তি শরীরে জড়ো হয়েছিলি নিমেষে উবে গেলো, একটা নতুন উদ্দমে কাজ শুরু করলাম, সঞ্জুকে ফোনে ডেকে নিলাম, পচাকে বললাম তুই বাজারে থাকবি নিরঞ্জনদা এলেই সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে চলে যাবি। ওকে নিরঞ্জনদার ফোন নম্বর দিলাম, বললাম পারলে চকে চলে যা। বাসুকে বললাম, লতাকে চলে আসতে বল, আমি একফাঁকে কাঞ্চনকে বলে এলাম তুমি ও বাড়িতে চলে আসবে। ওরা তো ফিরে আসার পর জানলো। আজকে আমরা সকলে বড়মার কথা মতো সবাই ঠিক ঠিক কাজ করেছি।
হাসলাম, চিকনার দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা সিগারেট দিবি।
চিকনা ৫৫৫ প্যাকেট বার করলো।
আমি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছি।
দাদা দিয়েছে। বললো, চিকনা রাখ কাজে লাগবে। তুই বিশ্বাস কর সঞ্জু কতবার চেয়েছে দিইনি বলেছি অনিকে দিয়ে ফার্স্ট বউনি করবো তারপর তুই পাবি। তুই প্যাকেটটা খোল।
তুই খোল।
দাঁড়া তার আগে তোকে একটা পেন্নাম করি।
আবার পেন্নাম কেনো।
তুই আমায় নতুন জীবন দিয়েছিস, সেই উপলক্ষে তোকে পেন্নাম করা হয় নি।
চিকনা পচা পাঁচু তিনজনে পেন্নাম করলো।
কবে বাঁশ দিবি।
চিকনা জিভ বার করছে। কান মুলছে।
শালা তোকে যদি বাঁশ দেয় পচা পুকুরে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো না। সঞ্জু বললো।
বল অনি তুই বল কি কথার কি মানে করলো, মাথা গরম হয়ে যাবে না। সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললো, এই কথার জন্য গোটা হবে না, কাউন্টার।
চিকনা একটা আমাকে একটা বাসুকে একটা অনাদিকে দিয়ে ওদের সবাই একটা করে দিলো, আমার দিকে লাইটার এগিয়ে দিয়ে বললো, তোর হিসাবটা কালকে বুঝিয়ে দেবো।
কেমন চলছে।
টাকার টান পরছে।
আর অসুবিধে হবে না। আমি নিয়ে এসেছি। দিয়ে যাবো। কাল থেকে তুলতে আরম্ভ কর।
সে কি বাকি রেখেছি, সঞ্জুর কাছ থেকে টেনেছি, অনাদির কাছ থেকে টেনেছি, বাসুর কাছ থেকে টেনেছি।
হিসেব করে রেখেছিস তো। কাকে কত দিতে হবে।
আমার এ্যাকাউন্টেটটা জব্বর একটুও জল মেশাতে দেয় না।
তার মানে তোর জল মেশাবার ইচ্ছে আছে।
হ্যাঁ, চা-পান-বিড়ির পয়সা দেবে না। তুই বল।
অনাদি বাসু হাসছে।
শালা কতটাকা লাগেরে।
সঞ্জু আজ একটা শুভ দিন আমার কিন্তু মাথা ঠান্ডা আছে।
সেটাতো দিতেই হবে। এটা যদি নীপা না দেয় তাহলে অন্যায় করেছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম।
তুই ওকে একটু বলে দে।
ঠিক আছে।
সেদিন যে ঝামেলাটা করলি। বল অনিকে। অনাদি বললো।

নারে ঝামেলা না, ও শালা অনাদি ঢেমনামো করছে।
আবার শুরু করলি।
চিকনা কান ধরল নাকে খত দিলো, আর হবে না, বিশ্বাস কর। সিগারেটে একটা সুখ টান দিলো।
কি হয়েছে বল।
পদিবুড়ো ভিঁজে ধান নিয়ে এসেছে, আমি পাঁচ সের বাদ দিয়েছি, ও গিয়ে অনাদিকে রিপোর্ট করেছে।
কি করে বুঝলি।
অনাদিকে জিজ্ঞাসা কর আমি ভজিয়ে দিয়েছি। খামারে শুকনো করে দেখলাম, দশসের কম। আমার পাঁচ সের লস।
অনাদি হো হো করে হাসছে।
পচা পাঁচুকে মাইনে দিয়েছিস।
টাকা নাই। বলেছি অনি আসুক, পেয়ে যাবি।
কিছু ধান বিক্রী করে দিলিনা কেনো।
যে দামে কিনেছি তার থেকে পাঁচ সাতটাকা বেশি পাবো তাতে কি হয় বলতো।
ধান থেকে চাল করার ব্যাপারে কি করলি।
সঞ্জু মেশিন দেখে এসেছে। তুই বললে শুরু করবো। ধান সেদ্ধর জন্য জালন কিনতে হবে, চারপাখা উনুন বানাতে হবে। আরো পাঁচসাতজন লাগবে।
জোগাড় করেছিস।
সে কতোক্ষণ। বললেই চলে আসবে।
অনাদি একটা বাজেট করে দেতো। তুই ধরে নিবি তোর হাতে দশলাখ টাকা থাকবে, এইটা ধরে।
এতটাকা কি হবে।
কেনো।
তিন চার লাখ টাকা যথেষ্ট।
কেন।
এখানে অতো ধান পাবি কোথায়।
চারিদিকে বলে রাখ, চকে আর ধান যাবে না, মাঝপথে এখানে সবাই দেবে, প্রয়োজনে চকের দামেই ধান কেনা হবে।
তাই। তাহলে লাগবে।
মেসিন–ফেসিন কি কনতে হবে বললো।
সে আর কত লাগবে, সঞ্জু। অনাদি বললো।
লাস্ট যা কোটেসন নিয়েছিলাম হাজার চল্লিশেক বলেছিলো।
তোর কত থাকবে। আমি বললাম।
বেশি না হাজার খানেক।
শালা ঢেমনা আমার কাছ থেকে বিজনেস। চিকনা বললো।
কেনো তুই আমার নাং।
উনা মাস্টারের মেয়েকে ভাঙচি দেবো।
তোর দাঁত গুলো ভাঙে দেবো।
আবার কার দাঁত ভাঙবে সঞ্জুদা। নীপা চায়ের ট্রে মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
চিকনার।
কেনো।
তোকে বলা যাবে না।
বাবাঃ গম্ভীর হয়ে গেলে যেনো, মনে থাকে যেনো কথাটা, নীপা........
চিকনা হাত তালি দিয়ে উঠলো। বলবো ওকে। পয়সা উসুল হয়ে যাবে।
কি গো চিকনাদা।
পরে বলবো, আগে মিষ্টিটা দে, চায়ের কাপটা নিচে রাখ।
সঞ্জু ভ্যাটকা মুখে বসে আছে।
আমি বাসু অনাদি হাসছি।
তোমার কীর্তিকলাপ নিয়ে ও বাড়িতে বিরাট আড্ডা বসেছে। হ্যাঁগো অদিতি কে।
তুমি কি করে জানলে।
মিত্রাদি সবাইকে তোমার গুণকীর্তন শোনাচ্ছে সবাই হেসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
তুমি চলে এলে।
এখন ইন্টারভেল, আমি গেলে আবার শুরু হবে।
তারমানে জব্বর আড্ডা বসেছে বলো।
অবশ্যই।
তোমার অনিদা খুব ভালোছেলে ছিলো তো।
আমার অনিদা কোনোদিন খারাপ ছেলে ছিলো না, আজও নেই।
অনাদি একটা ছেলে জোগাড় করতো বিয়ে দিয়ে দিই।
তুই খালি একবার আমাকে মুখে বল, আধঘন্টা সময় নেবো। চিকনা বললো।
তারমানে।
নীপা চিকনার মাথায় একটা থাপ্পর মারলো, শয়তান খালি পেটে পেটে বদ বুদ্ধি।
জল মেশাতে দিবি।
একবারে না।
তাহলে রিপোর্ট জমা দেবো।
দাওনা। কে বারন করেছে।
নীপা নাচতে নাচতে চলে গেলো।
ঠিক আছে কাল একটা হিসাব করে দেবো তোর। এইবার উঠে পরে লেগে পর। আমি কাগজপত্র সব তৈরি করে নিয়ে এসেছি। দেখ ও বাড়িতে কোনো কাজ কর্ম আছে নাকি।
সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললাম তুই দেখ লাইটগুলো একবার ঠিকঠাক জলছে নাকি, পারলে একটু হেল্প কর ওদের গিয়ে, আর বড়মার ঘরটা একবার দেখে নিস, রাতে সমস্যা হলে মাথা ভেঙে দেবে।
ওরা চলে গেলো।
অনাদিকে বললাম, উনা মাস্টার কি বলতে চায়।
উনা মাস্টারের ইচ্ছে নেই, মাসিমার ইচ্ছে আছে।
সঞ্জুতো খারাপ ছেলে নয়।
শালা নেশা করে।
বেশি না একটু আধটু।
ওই আর কি।
তুই কিছু বলিস না।
বলি।
আমি বললে কাজ হবে। তাহলে একবার স্যারের কাছে যাবো।
তুই গেলে সলভ হয়ে যাবে।
চল তাহলে এক ফাঁকে তুই আমি আর বাসু চলে যাই।
তুই ঘটকালি করবি।
প্রয়োজনে করবো।
বাসু হো হো করে হেসে ফেললো।
হাসছিস কেনো।
তোর আর কি কি বাকি রয়েছে।
অনেক।
জানিস অনি আজকে খুব ভালো লাগছে।
কেনো। 
 
 
 
 
 
 
 
Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks