দেখি নাই ফিরে - (Part-73)

সবাই আমার সঙ্গে আলাপ করলো। মেয়েগুলো আমাকে দেখে মুচকি হাসে। বিশেষ করে লীনা বলে মেয়েটি।
আমাদের প্রথম ক্যাম্পেনিং সেই চায়ের বিজ্ঞাপনটা তোমাদের মনে আছে। বহুবার গল্প বলেছি তোমাদের।
হ্যাঁ স্যার চুমুকে চমক।
ঠিক বলেছো।
ওটা অনির করা। সেইদিন ত্রিকায়ার নাম সবাই জেনেছিলো। আজ আট বছর পর ও আবার এই কাজে হাত দিলো। আশা রাখছি তোমরা নতুন কিছু পাবে।
আমরা স্যার অনিদার সঙ্গে কাজ করতে পারি না।
সবই তোমরা করবে, ও খালি লে-আউট ডিজাইন প্ল্যানিং করে দেবে।
বেশ কিছুক্ষণ গেঁজাবার পর উঠলাম। সুজিতদাকে আমার কার্ডটা দিলাম। মেটেরিয়াল গুলো সাতটার সময় এই এ্যাড্রেসে নিয়ে এসো আমি থাকবো।
এতো ট্র্যাংগুলার পার্কের ঠিকানা।
হ্যাঁ।
আমার বাড়ির থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব।
আমি এখন এখানেই থাকি। চলে এসো। সাড়ে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত তোমার জন্য অপেক্ষা করবো তারপর ফুটে যাবো।
আমি ঠিক ওই টাইমের মধ্যে যাবো।
তুই একটু চম্পককে বলে দে।
বলে দেবো।
বেরিয়ে এলাম। ফাইলাটা বগল দাবা করে নিচে নামলাম। পার্কস্ট্রীটের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে অন করলাম। মিস কল আর ফোন। দেখলাম তার মধ্যে মিত্রার মিস কল সব চেয়ে বেশি। একটা ম্যাসেজও করেছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিস। বড়মা কথা দিয়েছিলি আজ বেরোবি না।
আবার ম্যাসেজ পোনটা অফ করে রেখেছিস কেনো। অনেক জিনিষ কিনেছি। তোকে কাল সাজাবো। আমার মনের মতো করে।
হঠাৎ পাগলটার দিকে চোখ পরতেই হেসে ফেললো। থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তার ধারের ডাসবিনে বসে এঁঠো পাতা থেকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে। চিনতে পারলাম। চোখ মারলাম। সোজা হাঁটতে হাঁটতে এসে দুটো সিগারেট কিনলাম। এ্যাসিয়াটিক সোসাইটির সিঁড়িতে বসলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। একটা হাতে রাখলাম। সুজিত হেলতে দুলতে হাঁসতে হাঁসতে আমার পাশে এসে বসলো। আমি যে সিঁড়িতে বসলাম তার এক ধাপ নিচে। সিগারেটটা ইচ্ছে করে ফেলেদিলাম। সুজিত কুড়িয়ে নিয়ে টানতে শুরু করলো। আমি ওর কাঁধে হাত দিয়ে সিগারটটা দিতে বললাম। ও চোখ মারলো। দিলো আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর সিগারেট থেকে আমার গোটা সিগারেটটা ধরালাম। দু’একজন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দেখে বাঁকা চোখে হাসলো।
সিগারেট খাচ্ছি আর নিজের মনে কথা বলছি। কিরে এখানে কি করতে।
সুজিতও সিগারেট খাচ্ছে আর মাথা নীচু করে ধুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার কথার উত্তর দিয়ে চলেছে।
তোমার লেখার রিঅ্যাকসন। ঘুম করে নিয়েছো। ওদিকে সাদা পোষাকের মাল তোমায় আমায় লক্ষ্য করছে।
আমাকে চেনে।
না।
মাপছে।
মাপছে।
তাহলে ফুটে যাই।
বোসোনা অসুবিধে নেই।
তাহলে আর দুটো সিগারেট কিনি আনি। আমি উঠে চলে গেলাম। সিগারেটের দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনলাম সুজিত আমার পেছন পেছন এসে আমার গায়ে হাত দিয়ে সিগারেট চাইলো। একজন নোংরা পাগল একজন ভদ্রলোকের গায়ে হাত দিয়ে সিগারেট চাইলে যা করে আমি সুজিতকে তাই করলাম। উপরন্তু একটা সিগারেট দিলাম। আবার এসে বসলাম।
সুজিত আমার পেছন পেছন এসে একটু দূরত্ব নিয়ে বসলো। চোখ চারিদিকে সজাগ।

গুরু দারুণ এ্যাকটিং করলে। মাল পুরো হাওয়া।
তোর কি আজকে এখানে ডিউটি।
কি করবো। কিছুই পাচ্ছি না। তোমাকে যাবার সময় দেখেছি।
লক্ষ্য করিনি।
জানতাম। তোমার চোখ। দেখলে একবার থমকে দাঁড়াতে।
তখন কোথায় ছিলি।
ব্লুফক্সের ধারে।
এখানে কিসের গন্ধ।
শুনছিতো আমেরিকান হাউসে এ্যাটাক হবে।
খবরটা দিস। আমার নম্বর আছে।
না।
ইচ্ছে করে মানি পার্টসটা বার করে উঠে দাঁড়ালাম একটা কার্ড বার করে হাতে রাখলাম। হাতের ফাইলটা খুলে পরতে শুরু করলাম। আরো কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে গেঁজালাম। কার্ডটা ফেলে উঠে চলে এলাম।
মোবাইলের ঘরিটা দেখলাম ছটা বাজে। সোজা একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম। আসার সময় সুজিতদাকে একটা ফোন করলাম। আমি বাড়িতে ঢুকছি তুমি পারলে তাড়াতাড়ি চলে এসো আমার একটু কাজ পরেছে বেরোবো।
আমি বেরোচ্ছি মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাবো।
বাড়ির গেটে ট্যাক্সি দাঁড় করতাই ছগনলাল গেট খুললো।
তুমি কোথায় ছিলে।
কেনো গো।
দিদিমনি দু’বার এসেছিলো। কি সব রেখে চলে গেছে।
তুমি লাইট জালাও নি কেনো।
কেউ নেই তাই।
আমি নিচের লাইট জালালাম। সবে সন্ধ্যা হয়েছে। ছগনলালকে বলে এলাম কেউ আমাকে খুঁজতে এলে ডাকবে।
আচ্ছা।
ওপরে এসে নিজের ঘরে ঢুকলাম। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলাম। একবার মিঃ মুখার্জীকে ফোন করলাম।
কি স্যার কি খবর।
রবিবার একবার সময় রাখবেন। সন্ধ্যার পর আমার এখানে একবার আসতে হবে।
হো হো করে হেসে ফেললেন।
হাসছেন যে।
নেমন্তন্ন এই তো।
হ্যাঁ।
জানি।
কি করে।
দাদা ফোন করেছিলেন।
তাহলেতো সবই জেনেছেন।
যাক পাখি এবার দাঁড়ে বসবে।
পার্ক স্ট্রিটে লোকজন ঘুরতে দেখলাম।
এ খবর পেলেন কোথা থেকে।
বলুন না আমি যা বলছি সত্যি কিনা।
সত্যি।
আমেরিকান হাউস টার্গেট।
সেরকমই খবর।
আমি যেনো পাই মাথায় রাখবেন।
আচ্ছা আপনি খবরটা পেলেন কোথা থেকে ?
পেয়েছি।
সত্যি এবার আপনার পেছনে আমাকে লোক লাগাতে হবে।
লাগান। কে বারণ করেছে।
সত্যি আপনি ইনভিজিবিল ম্যান।
হাসলাম। রাখি।



আচ্ছা।
ছগনলাল নিচ থেকে ডাকছে। ফোনটা কেটে দিয়ে বারান্দায় এলাম। দেখলাম বাইরের গেটে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিচে নেমে গেলাম। দেখলাম সুজিতদা। পেছনে আর একজন বসে আছে।
ভেতরে ঢুকতে বলবিনা, তোর বৌদি বিয়ে বাড়িতে যাবে তাড়া আছে।
কাল তোমার বাড়িতে যাবো। রাতের দিকে।
তাহলেতো খুব ভালো হয়।
পেছন থেকে আমার ড্রইংবোর্ড কাগজ তুলি রংএর বাক্স সব নামালাম।
সুজিতদা আমার হাতে একটা ব্যাগ দিয়ে বললো। এইনে তোর কমিশন। ক্যাশ।
সত্যি তুমি এনেছো। আমি এমনি বললাম।
তার মানে। তোর জন্য এতো বড়ো কাজটা পেলাম। তুই সুজিতদাকে কি মনে করিস।
হাসলাম।
এখন গুনবি না। ভেতরে নিয়ে চলে যা।
সুজিতদা ভোঁ করে বেরিয়ে গেলো।
ছগনলাল আমাকে জিনিষ গুলো ওপরে নিয়ে যেতে সাহায্য করলো। আমি বললাম আমাকে একটু চা খাওয়াতে পারো।
তুমি সকাল থেকে কিছু খাও নি।
খেয়েছি তুমি একটু চা করো।
আমি ব্যাগের চেনটা খুলে একবার দেখে নিলাম। সব হাজার টাকার বান্ডিল। গুনলাম না। হাতটা ভীষণ উসখুস করছে ছবি আঁকার জন্য। সব সেট করে নিলাম। বিছানা ময় ছড়িয়ে দিলাম। বাথরুম থেকে মগে করে জল আনলাম। বালতি করে এক বালতি জল আনলাম। জামা পেন্টটা টেনে খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। নিমেষের মধ্যে ঘরের চেহারাটাই বদলে গেলো। ড্রেস মেটিরিয়ালসের ছবি আগে এঁকে ফেলতে হবে।
আমার দীর্ঘদিনের অভুক্ত খাবার আজ পেয়েছি। সুজিতদার কাছেই শেষ কাজটা করেছিলাম। মাথার মধ্যে সব যেনো কিল বিল করছে।
টাওয়েলটা পরে নিলাম। ছগনলাল চা দিয়ে গেলো। আমি ড্র করতে শুরু করলাম। বার বার পিঙ্কি চুর্ণী তিয়া রিমঝিমের মুখ গুলো ভেসে উঠছে। বিশেষ করে তিয়ার মুখটা হাতের পেন্সিল হ্যান্ড মেড পেপারের ওপর চলতে শুরু করলো। পর পর অনেক গুলো স্কেচ করে ফেললাম ঘরের চারদিকে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলি আর এঁকে যাই। একজন মানুষ যখন দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকে তারপর যখন খেতে পায়, সে যেভাবে খায় আমিও যেনো সেই ভাবে এঁকে চলেছি।
ক্রমশঃ

মিঃ নেওটিয়া বলছিলেন প্রথমে উনি মেয়েদের ড্রেস মেটিরিয়াল দিয়ে শুরু করবেন। আমাকে তারও ড্রইং করে দিতে হবে। সিকোয়েন্স গুলো মনে মনে একবার সাজিয়ে নিলাম। হ্যান্ড মেড পেপারগুলো আগে ভালো করে বালতির জলে ডুবিয়ে নিলাম। প্রথমে একটা প্রকৃতির দৃশ্য আঁকলাম, তারপর ক্যাটওয়ার্ক গুলো তৈরি করলাম। এবার রেম্পে হাঁটার থেকে আরম্ভ করে পর পর সিকোয়েন্স গুলোর স্কেচ আঁকতে শুরু করলাম।
অনেকদিন পর তুলি হাতে পেয়ে মনেহচ্ছে আমি যেনো স্বর্গ হাতে পেয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম, এই মুহূর্তে স্কেচগুলো আমার সবচেয়ে বেশি আপনজন। কোনোদিকে খেয়াল নেই। আমি আমার সাধনায় নিমগ্ন। কতোক্ষণ এঁকেছি, কতগুলো ছবি এঁকেছি জানি না। পর পর মনে যা এসেছে, যে ভাবে ভেবেছি তুলির রং-এ তাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আঁকা শেষ হলে একটা একটা করে খাটের ওপর রেখে এসেছি। আঁকতে আঁকতে হঠাৎ দেখলাম কে যেন আমার ড্রইং বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ালো, তার ছায়া আমার ড্রইং বোর্ডে পরেছে। চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম মিত্রা। হেসে ফেললাম।
ঝট করে রং-এর প্লেটটা রেখে ওকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে একপাক ঘুড়ে নিলাম। ওকে কোলে তুলে নিলাম।
মিত্রা মিত্রা আমার মিত্রা।
ছাড় ছাড় পরে যাবো। তোর কোথাও লেগে যাবে আবার।
আমি ছাড়লামনা ওকে জাপ্টে ধরে বললাম, জানিষ আজ আমি জিতে গেছি।
তখনও ও আমার কোলে। আমার গলা জড়িয়ে ধরে আছে।
আমাকে নিচে নামা আমি পড়ে যাবো।
আমিতো আছি, কেনো তুই পড়ে যাবি ? তুই পড়ে গেলে আমি তোকে ধরে ফেলবো।
প্লিজ তুই নিচে নামা।
আমি ওকে নিচে নামালাম।
ওর দিকে তাকালম। চোখে জল টল টল করছে।
এমা তুই কাঁদছিস কেনো ?আমি আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। তুই বিশ্বাস কর, তুই তখন বললি না। জানিস আমি আজ একটা বিরাট কাজ পেয়েছি। আট বছর পর।
ও আমার দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে।
কাঁদিস না। তাহলে আমার মনটা খারাপ হয়ে যাবে। আমিতো তোর কথা রেখেছি।
আমার দু’হাতের আঁজলায় ওর মুখ তুলে ধরলাম। বুড়ো আঙুল দিয়ে ওর চোখ মোছালাম। কপালে একটা চুমু খেলাম।
আমি হরে গেছি বুবুন।
কে বললো তুই হেরেগেছিস! তুই জিতেগেছিস। দেখ আমি তোর কথা রেখেছি। সাতটার সময় চলে এসেছি। আর কোথাও বেরই নি। পাগলের মতো খালি আঁকছি। অনেকদিন তুলি ধরিনি বুঝলি।
মিত্রা আমার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
এই দেখো আবার কাঁদে, তুই সুজিতদাকে চিনিস।
তারপর নিজে নিজেই বলে উঠলাম।
সত্যিতো তুই সুজিতদাকে চিনবি কি করে। আমিতো তোকে সুজিতদার কথা আগে কখনো বলিনি। জানিস সুজিতদা আমাকে একটা বিরাট কাজ দিয়েছে। কততো টাকা দিয়েছে জানিস।
আমি ওকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে গেলাম খাটের কাছে। ব্যাগটা খুলে বললাম এই দেখ। কতো টাকা গুনি নি। সুজিতদা বলেছে তুই গুনবি না। এই দেখ, আর একটা চেক দিয়েছে। দেখ দেখ।
আমি ফাইলটা থেকে চেকটা বার করলাম। ওর হাতে দিলাম। সব তোর। আমি তোকে দিলাম।
মিত্রা চেকটা হাতে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
এমা, এই দেখো আবার বোকার মতো কাঁদে। আমিতো তোর কথা রেখেছি। এবার তুই নিশ্চই আমার সঙ্গে থাকবি। আমাকে ছেড়ে যাবি না।
মিত্রা আরো জোড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, তুই আর বলিস না।
কেনো। আমি কি আবার অন্যায় করলাম ?
তোকে আমি সকালে বেলা অনেক খারাপ কথা বলেছি।
কই নাতো! ওগুলো তোর মনের কথা নয়। তখন তুই আমার ওপর রেগে গেছিলি। আমি সত্যি তখন অন্যায় করেছিলাম। তাই তুই বলেছিস। তুই বিশ্বাস কর আমি একটুও রাগ করিনি।
আবার ওকে খাটের কাছে নিয়ে গেলাম।
দেখনা দেখ আমি এরি মধ্যে কতগুলো ছবি এঁকেছি। কেমন এঁকেছি বল।
মিত্রা ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকালো। ভালো।
শুধু ভালো! আর কিছু নয় ?
মিত্রা আমার বুকে ঠোঁট রাখলো।
হ্যাঁ, হেসে ফেললাম এইবার বুঝলাম, শুধু ভালো নয়, তার থেকেও যদি কিছু থাকে, তাই।
মিত্রা হেসে ফেললো।

চা খাসনি কেনো।
হ্যাঁ খেয়েছি, ছগনলাল একবার দিয়েছে।
তুই খেয়েছিস!
হ্যাঁ।
তাহলে ওটা কি।
কই দেখি।
আমি চায়ের কাপটা দেখলাম। যেমন দিয়ে গেছিলো তেমন পরে আছে।
তাহলে হয়তো ছগনলাল পরে আর একবার দিয়ে গেছে। এখন আমাকে একটু চা খাওয়াবি।
কটা বাজে জানিস।
কটা ? তুই এলি, এখন তাই নটা বাজে।
মিত্রা আমার মুখে হাত দিলো। কিছু খোঁজার চেষ্টা। চোখদুটো জলে টলটল, স্থির।
সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
তোরা অনেকক্ষণ এসেছিস!
হ্যাঁ।
আমাকে ডাকলি কেনো।
তোর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটুক কেউ তা চায়নি।
হেসে ফেললাম।
ডাক ডাক সকলকে ডাক।
মিত্রা এগিয়ে গেলো।
দাঁড়া দাঁড়া পাজামাটা পরে নিই, টাওয়েল পরা আছে। ওরা আবার কে কি মনে করবে।
ওরা সবাই তোকে এই অবস্থায় দেখে গেছে।
এমা, তুই বারন করতে পারলি না।
মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
আমি তাড়া হুড়ো করে পাজামাটা পরে নিলাম।
মিত্রা গিয়ে দরজা খুললো। দেবারা সবাই ঘরের মধ্যে এলো। আমি হাসলাম।
তুই এগুলো কি করছিস!
জানিস দেবা আজ হঠাৎ একটা কাজ পেয়ে গেলাম। একটা এ্যাড প্রমোসনের।
তুমি এ্যাড প্রমোসনের কাজ করছো!
হ্যাঁগো টিনা। আগেতো করেছি কয়েকবার। অনেক দিন পর আবার একটা সুযোগ পেলাম, ছাড়লাম না, লোভ হলো কাজটা করতে, নিয়ে নিলাম।
এই ছবি গুলো তো ড্রেস মেটিরিয়েলের। মিলি বললো।
হ্যাঁ। ওরা প্রথমে ওদের ড্রেস মেটেরিয়াল লঞ্চ করবে। মডেলরা রেম্পে হেঁটে সেই ড্রেস মেটিরিয়াল শো করাবে। আমি খালি এ্যাঙ্গেল গুলো ঠিক করে স্কেচ গুলো ড্র করে দিচ্ছি।
তুমি আগে করেছো কখনো!
অনেকদিন আগে করেছিলাম। তোমাদের মনে আছে কিনা জানি না, একটা চায়ের বিজ্ঞাপনে একটা ক্যাপসান খুব হিট করেছিলো, চুমুকে চমক।
হ্যাঁ। মনে আছে।
ওই চায়ের টোটাল এ্যাড প্রোমোশনটা আমি করেছিলাম। সেই থেকে সুজিতদার ব্যাবসার উন্নতি।
সুজিতদা! ত্রিকায়! দেবাশীষ বললো।
হ্যাঁ। তুই চিনিস।
চিনবনা মানে ?
আমি ধীর পায়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাইরেটা অন্ধকার। পাঁচিলের বাইরে মিউনিসিপ্যালিটির লাইট পোস্ট থেকে যে টুকু আলো আসছে তাতেই বাগানটা আলোকিত। আকাশের তারা গুলো ফ্যাকাশে।
তখন আমি স্বাধীন সাংবাদিক বুঝলি দেবা। সুজিতদার সঙ্গে আলাপ হলো পার্ক হোটেলের একটা প্রোগ্রামে। দাদা কভার করতে পাঠিয়েছিল। কথায় কথায় বললাম আমাকে কিছু কাজ দিন না। তখন খেতে পাই না। যদি কিছু আসে। তা বললো তুমি কপারাইট করতে পারো। বললাম পারি না, তবে দিলে একবার চেষ্টা করবো। উনি দিলেন, পাশ করে গেলাম।
সেই থেকে শুরু। তারপর হৃদ্যতা, এমনকি সুজিতদার অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছেগেলাম। অনেকগুলো কাজ করেছি সুজিতদার। মাঝে সুজিতদার সঙ্গে একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। তবে ত্রিকায়া যে তার নিজস্ব ঢঙে, নিজস্ব স্বকীয়তায় এগিয়ে চলেছে তার খোঁজখবর রাখতাম। তোর শ্রেণিকদাকে মনে আছে। রেডিফিউসন যার হাতে তৈরি।
হ্যাঁ। খুব ভালো করে চিনি।
শ্রেণিকদা খুব ভালো স্পোর্টসের ওপর লিখতেন।
উনিতো স্পোর্টস রিপোর্টার ছিলেন। সুজিতদার মতো শ্রেণিকদার সঙ্গেও আমার আলাপ খেলার মাঠে। তখন শ্রেণিকদারও প্রচুর বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল কপিরাইট চারলাইনের বিজ্ঞাপণী গান লিখে দিয়েছি। এককথায় বলতে পারিস দেহপসারিণী। যেখানে দুটো পয়সা সেখানেই আমি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

জানিস দেবা, আজ সকালে মিত্রার কিছু কথায় মনটা খুব খারাপ লাগলো। এতে মিত্রার কোনো দোষ নেই। দোষ সম্পূর্ণ আমার। তোরা সবাই চলে যাবার পর, নিজের সঙ্গে নিজে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলাম। একবার ভাবলাম গঙ্গার ধারে আমার পুরনো ঠেকায় চলে যাই। কিছুক্ষণ জলে ভেসে চলে আসবো। তারপর নিজের মনে খুঁজতে শুরু করলাম আমার পুরোনো ভালোবাসার লোকজন কে আছে, যার কাছে গিয়ে আমি দু’দন্ড শান্তি পাবো। এক কথায় বলতে পারিস ব্রেক।
ট্র্যাংগুলার পার্ক থেকে বাসে উঠলাম। কোথায় নামবো জানি না। পার্ক স্ট্রীটে এসে ভাবলাম এখানে নেমে পরি। বাস থেকে নামলাম। একবার ভাবলাম মিত্রার ক্লাবে যাই। ওখানে আমার এক পুরনো বন্ধু আছে। তারপর ভাবলাম না, তাতে মিত্রার সম্মানহানি হতে পারে। আফটার এল আমি মিত্রার একজন পার্টনার। তারপরই সুজিতদার মুখটা ভেসে উঠলো। অনেকদিন সুজিতদার সঙ্গে দেখা হয় নি। গেলে চিন্তে পারবে কি ? তবু গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি সুজিতদার কাছে কিছু টাকা চাইতে গেছিলাম। ওই মুহূর্তে আমার কিছু টাকার দরকার ছিল।
একটু থামলাম।
নিশ্চিত তুই মনে মনে হাসছিস। অনি তোর আবার টাকার দরকার, তারজন্য সুজিতদা! হ্যাঁ দেবা, আমার হাতের মুঠোয় রাজ্য এবং রাজকন্যা। আমার আবার কিসের টাকার দরকার ? আচ্ছা বলতো দেবা, আমি এখনো পর্যন্ত যা পেয়েছি, যা করেছি তার একটা পয়সাও আমার ?
সুজিতদাকে মনের কথাটা বলেছিলাম। সুজিতদা থাপ্পর মারতে গেলো। এটাই স্বাভাবিক। অনেকটা তোর মনে মনে হাসির মতো। আমিতো সুজিতদাকে আমার মনটা খুলে দেখাতে পারি নি।
তারপর গঙ্গাদিয়ে অনেক জল গড়ালো। আলটিমেট সুজিতদা কাজটা আমাকে অফার করলো।ভালো টাকা দেবে বললো, লোভ সামলাতে পারলাম না।
ফিরে তাকালাম ওদের দিকে, হয়তো চোখ দিয়ে দু’এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এসেছিলো। ডান হাতের তালু দিয়ে তা মুছলাম।
ওরা সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
জানিস আমরতো এসব কিছুই ছিলো না।সুজিতদা কিনে দিয়ে গেলো।
আদিতি আমার কাছে এগিয় এসে বললো, তুমি এতো ভালো স্কেচ করতে পারো!
এগুলো আর ভালো কোথায়, মনের ভাবটা প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। বাকিটা ওরা করে নেবে।
টিনার দিকে তাকালাম।
টিনা তোমাদের জন্য একটা সুখবর আছে।
আমাদের জন্য!
হ্যাঁ। ওই ফাইলটা দাও।
আমরা দেখেছি।
তোমরা দেখেছো! কখন?
তখন তুমি একমনে স্কেচ করছিলে।
এমা আমাকে ডাকো নি কেনো?

কিভাবে সাধনা করতে হয় তোমার কাছ থেকে শিখছিলাম। বড়মা বললো ওকে দেখে তোরা শেখ। এখন বিরক্ত করিস না, ওর সাধনায় ব্যাঘাত ঘটবে। টিনা বললো।
বোকা বোকা কথা।
ওরা কেমন ভাবে যেনো আমার দিকে তাকালো।
জানো মিঃ নেওটিয়া কাজটা অন্য একটা এজেন্সীকে দিতে চেয়েছিলেন। ভাগ্যিস আমি আজ সুজিতদার কাছে গেছিলাম। সুজিতদা আমার সঙ্গে ওনার আলাপ করিয়ে দেবার পর উনি একেবারে গদ গদ হয়ে পরলেন, আফটার অল কাগজের মালিক বলে কথা। ওনার প্রোডাক্টগুলো শোনার পর, আমি ওনাকে ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে বোঝালাম। উনি আমার কনসেপটা এ্যাকসেপ্ট করলেন। সুজিতদাকে দিয়ে প্রমিস করালেন অনিবাবু যদি নিজে দায়িত্বে কাজটা করেন তাহলে উনি কাজটা দিতে পারেন। সেই সময় সুজিতদার সেই চোখের চাহুনি আমি এড়িয়ে যেতে পারলাম না। সম্মতি দিলাম। উনি সুজিতদাকে কাজটা দিলেন।
দাদা হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলেন পেছন পেছন সবাই।
আমি ছুটে গিয়ে দাদাকে প্রণাম করলাম। হঠাৎ কেমন যেনো হয়ে গেলাম।
জানো দাদা আজ অনি অনেক টাকা রোজগার করেফেলেছে।
দাদা হাসলেন, অনেক টাকা।
দেখো দেখো এই ব্যাগে টাকা আছে, এই দেখো চেক।
তোরতো টাকার দরকার নেই কি করবি এগুলো।
আমি মিত্রাকে সব দিয়ে দিয়েছি। বলেছি, এটা তোর।
দাদা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
সকাল বেলা ও কি বললো যানো, ও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। গলাটা ধরে এলো।
তাই বুঝি।
হ্যাঁগো। মনটা খুব খারপ হয়ে গেলো। ভাবলাম কিছু একটা করতে হবে, কাজটা নিয়ে নিলাম। বলো ঠিক করিনি।
দেখলাম দাদার চোখটা ছল ছল করছে।
এমা তোমার চোখেও জল।
ছোটমা বড়মার দিকে তাকালাম।
ধ্যুস, বুঝেছি আমি কাজটা নিয়েছি তোমাদের কারুর পছন্দ নয়। কালকে সুজিতদাকে ফেরত দিয়ে দেবো।
দাদা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
বড়মা ছোটমার কাছে গেলাম, কিগো তোমরাও আমার এই কাজটাকে অপছন্দ করছো?
ডাক্তারদাদা এগিয়ে এলেন, তুই ছবি আঁক, আমরা পরে আসবো।
না ডাক্তারদাদা, এখন আর ছবি আঁকা হবে না।
কেনো।
ব্রেক হয়ে গেলো।
তাহলে নিচে চল।
যাও, আমি যাচ্ছি।
ওরা সবাই চলে গেলো। শুধু মিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো। আমি ড্রইংগুলো একজায়গায় পর পর সাজিয়ে রাখলাম। নিজের আঁকা স্কেচ গুলো বেশ দেখতে লাগছে। মিত্রা এগিয়ে এলো আমাকে সাহায্য করলো। আমার দিকে তাকাচ্ছে আর মিটি মিটি হাসছে।
তোর ছবিগুলো ভালো লাগেনি।
ও আমাকে জড়য়ি ধরলো।
তোর এই গুণটা আছে, আগে জানতাম না।
তোর ভালো লেগেছে।
হাঁ।
ব্যাশ, তাহলে আমি এই পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দেবো।
পারবি।
আলবাত পারবো।
তোর জন্য একটা জিনিষ নিয়ে এসেছি।
কিরে ?
একটা কথা দে।
বল।
কালকে আমি তোকে যেভাবে দেখতে চাইবো তুই সেই ভাবে আমাকে দেখাবি, বলতে পারিস আমার স্বপ্ন। তোর যেমন কিছু স্বপ্ন আছে, আমারও আছে। আমি তোকে কালকে দু’চোখ ভরে দেখতে চাই।
ধ্যুস আমি কি পুতুল, তুই পুতুল খেলবি।
ধরনা কালকের দিনটা আমি পুতুল খেলবো।
সে দেখা যাবে।
দেখা যাবে কেনো।
আমি মিত্রার গালটা একটু টিপে দিলাম।
আচ্ছা বাবা আচ্ছা তাই হবে। খিদে পেয়েছেরে।
নিচে চল।

জানিস মিত্রা একটা অন্যায় করে ফেলেছি।
মিত্রা আমার দিকে তাকালো।
কি অন্যায় করেছিস।
তোকে না জানিয়ে সুজিতদার সঙ্গে ছ’মাসের একটা এগ্রিমেন্ট সাইন করে ফেলেছি।
বেশ করেছিস।
তুই রাগ করলি না।
তোর ওপর রাগ করে নিজেই বেশি কষ্ট পাই। দেখলাম চেকও নিয়ে এসেছিস।
বাকিটা আগামী সপ্তাহে দিয়ে দেবে।
নিচে চল, খিদে পেয়েছে বললি। সকাল থেকে কি খেলি।
ছেঁড়া পরটা ঘুগনি।
কোথায় খেলি ?
সুজিতদার ওখানে।
সুজিতদা খাওয়ালো না তুই খেতে চাইলি।
হেসে ফেললাম।
চল।
দাঁড়া তুলি গুলো একটু ধুয়ে নিই।
তুই বালতি নিয়ে কি করছিলি।
কাগজগুলো জলে চোবালাম।
হ্যান্ডমেড পেপারগুলো জলে চুবিয়ে ছবি আঁকছিলি!
হ্যাঁরে, কালার গুলো তাতে দারুণ খেলে।
টাকা গুলো কি করবি।
ওটা তোর, তোকে তো কিছু দিতে পারিনি কোনো দিন।
আমি নিয়ে কি করবো। আমার অনেক টাকা। এটা তোর পরিশ্রমের টাকা।
মিত্রা আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথা নীচু করে নিলাম। স্বগোতক্তির সুরে বললাম।
ধার শোধ করবি।
তার জন্য তুই বিজ্ঞাপন এনে দিয়েছিস।
তোর যা খুশি করিস, ভাবতে ভালো লাগছে না।
এখনো ওই বিজ্ঞাপনের সিকোয়েন্স গুলো তোর মাথায় খালি ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই না ?
হেসে ফেললাম।
ডাক্তারদাদা ঠিক কথা বলেছে, ও এখন আর ওর মধ্যে নেই, তোমরা কোনো প্রশ্ন করলে ঠিক ঠিক জবাব পাবে না।
কেনো আমি কি কোনো অসংলগ্ন কথা বলছি?
বলছিস না, বলা হয়ে যাচ্ছে।
কিরে কি খুচুর খুচুর করছিস দু’জনে, নিচে চল।
ছোটমার গলা, দারজার মুখে দাঁড়িয়ে, আমি ছোটমার দিকে তাকালাম।
বুঝলে ছোটমা, গর্ধভটাকে নিয়ে চলা বড় কষ্ট, একটু মেরামত করার চেষ্টা করছি। মিত্রা বললো।
কি মনে হচ্ছে, পারবি।
হালতো ছাড়িনি, ছাড়বোও না।
দেখ চেষ্টা করে, আমি দিদি হাল ছেড়ে দিয়েছি।
আমি একবার ছোটমা একবার মিত্রার মুখের দিকে তাকাই। কি বলছে ঠিক এই মুহূর্তে মাথায় ঢুকছে না। মিত্রা ঠিক বলেছে। এ্যাডের সিকোয়েন্সগুলো এখনো মাথায় রিনিঝিনি তালে সুর রচনা করে চলেছে।
বুঝেছি, তোর এখন মাথায় কিছু ঢুকবে না। তুই এখন সব কিছুর মধ্যে রেম্প দেখছিস, মডেলদের ড্রেস মেটিরিয়াল দেখছিস।
চলোতো ছোটমা। খিদে লেগেছে।
মিত্রা মুখ টিপে হাসলো।
আমি ছোটমাকে টেনে নিয়ে নিচে চলে এলাম। দেখলাম সোফায় বসে সবাই গল্প করছে। দেবা অদিতি নির্মাল্যকে দেখতে পেলাম না। বড়মাকে দেখলাম রান্নাঘরে। এগিয়ে গেলাম। পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বড়মা আমার মুখের দিকে তাকালো।
খিদে পেয়েছে।
তোর কাজ শেষ হলো।
কই হলো, ওরা চলে এলো।
দুপুরে কোথায় গেছিলি ?
তুমি জানো না!
না।
পরে বোলবো।
কিরে তুই যে দেখবি বললি। মিত্রা এসে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়ালো।
কি বলতো ?
আমরা যা নিয়ে এলাম।
চল। দাঁড়া টিনাকে একটা কথা বলে নিই।
বড়মার ঘরে চল আগে।
তাই চল।
আমি মিত্রার পেছন পেছন বড়মার ঘরে এলাম। বড়মার খাটের ওপর ডাঁই করা কাপর জামার প্যাকেট। আমি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম।
এতো জামা কাপড়! কার ?
তোর আছে, আমার আছে, সবার আছে। মিত্রা বললো।
এতো কি হবে ?
দরকার আছে। তুই দুপুর বেলা ওই প্যান্ট গেঞ্জিটা পরে বেরিয়েছিলি কেনো। তোর আর জামা প্যান্ট নেই।
কি জানি, ভালো লাগলো, পরে নিলাম।
ওই জামা প্যান্ট পরলে অনিকে ঠিক অনির মতো লাগে তাই না।
মাথা নারলাম।
অন্য জামা প্যান্ট পরলে অনিকে বড্ডবেশি চক চকে মনে হয়।
তুই আমায় দেখেছিস!
মিত্রার স্থির চোখ আমার মুখে, হাসি হাসি চোখ দুটোয় না বলা অনেক কথা।
তুই একটা ভিখিরীর সঙ্গে এ্যাশিয়াটিক সোসাইটির সিঁড়িতে বসে কথা বলছিলি।
ও ভিখারী নয়।
আমার গলার স্বরটা হঠাৎ কর্কশ হয়ে গেলো। মিত্রা চমকে আমার দিকে তাকালো।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলাম। দেখলাম টিনা মিলি ছোটমা বড়মা ঘরের দরজা আটকে দাঁড়িয়ে।
টিনা। তোমায় কেউ ফোন করেছিলো।
না অনিদা।
তোমায় একজন ফোন করতে পারে। ওদের একটা এ্যাড সানডের পেজে যাওয়ার কথা। চম্পকদা তোমার কথা বলেছে, তোমার পার্মিসন ছাড়া এ্যাডটা যাবে না।

ওরা আমার গলার স্বরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আমার পার্মিসন ছাড়া এ্যাড যাবে না!
সেই রকমই বলা হয়েছে অফিস থেকে।
আমিতো এরকম কথা কখনো বলিনি অনিদা। টিনা বললো।
চম্পকদার সঙ্গে ওর দেখাই হয়নি কাল থেকে। মিত্রা বললো।
মিত্রার দিকে ঘুরে তাকালাম।
তাহলে বুঝতে পারছিস।
পারছি।
তুই ওদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে সাইন করে দিয়েছিস।
হ্যাঁ।
টিনার দিকে ঘুরলাম।
কাল তুমি চম্পকদাকে ফোন করবে। বলেদেবে ত্রিকায়া থেকে যে এ্যাডটা গেছে, ওটা রবিবার ছাপা হবে। যখন কথা বলবে তখন গলার ভলুমটা যেন হুইপের ঢঙে থাকে। মাথায় রাখবে তোমাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চম্পকদার মতো যারা আমাদের অফিসে আছেন, তাদের বস হিসাবে দেওয়া।
টিনা মাথা নীচু করলো।
তোমরা তোমাদের এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার কি লেখা আছে পরেছো।
না।
কেনো! না পরেই এক কপি সই করে দিয়েছো।
তুমি আছো।
চিরটা কাল নয়।
টিনা মিলি আমার মুখের দিকে ফ্যাকাশে চোখে তাকালো।
তুমি অদিতি মিলি এখন থেকে এ্যাডের পার্টটা একটু একটু করে টেকওভার করো। দেখবে, তোমাদের সাবোতাচ করার মতো লোক ওখানে অনেক পাবে। সব বাস্তু ঘুঘু। সবার সঙ্গে কথা বলে লোক চেনো। একটু কিছু গন্ধ পেলে আমাকে জানাবে। আজ আমি আগামী ছয় মাসের একটা এ্যাডকেম্পেন নিয়ে এসেছি, ফাইলটা ওপরে আছে, পারলে দেখ নাও।
দেখেছি।
তোমরা কখন এলে, কখন আমার ঘরে ঢুকলে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিছু বললেই, বলো দেখেছি।
তুইকি তখন তোর মধ্যে ছিলি। বড়মা বললো।
তাহলে কোথায় ছিলাম, আকাশে ডানা মেলে উড়ছিলাম।
সকলে হেসে ফেললো।
তাই হবে। সকলে তোর ঘরে গেলো এটা ওটা দেখলো, তুই কিছুই জানলি না।
হবে হয়তো।
টিনার দিকে তাকালম।
আগামী এক সপ্তাহ তোমাদের আমি সময় দিতে পারবো না। অসুবিধা হলে ফোন করবে।
আচ্ছা।
বড়মা জায়গা হয়েছে।
হ্যাঁ।
এগুলো দেখবি না। মিত্রা বললো।
আগে খেয়ে নিই, তারপর।
বেরিয়ে এলাম। খাবার টেবিলে না বসে সোফাতে দাদা আর মল্লিকদার মাঝখানে বসলাম। অপরজিটের সোফায় ডাক্তারদাদা বসে।
কিরে, অশান্ত মন শান্ত হলো।
ডাক্তারদাদার দিকে তাকালাম। মাথা নীচু করলাম।
হাসলাম।
তোকে কিন্তু আজকে দারুণ দেখাচ্ছিলো। ভাবলাম একবার গাড়ি থেকে নেমে যাই।
কোথায় দেখলে।
এ্যাসিয়াটিক সোসাইটির তলায়।
নামতে পারতে।
তুই তখন আমাকে পাত্তাই দিতিস না।
কেনো।
তাহলে ওই ভিক্ষারী ভদ্রলোক উঠে চলে যেতো।
হাসলাম।

আমি এদের তখনই বলেছি। ও ভিক্ষারী নয়, ও নিশ্চই অনির পরিচিত।
কি করে বুঝলে ?
তোর কথা বলার ধরণ দেখে। লোকে জানছে তুই ফাইল দেখছিস, কিন্তু আসলে তা নয়।
সত্যি বুবুন ও ভিক্ষারী নয়! মিত্রা আব্দারের ঢঙে বললো।
কেনো।
ডাক্তারদাদার সঙ্গে আমারা চ্যালেঞ্জ করেছি।
তাহলে হেরে গেছিস।
ও ভিক্ষারী নয়!
না। ও একজন আইবির সিনিয়ার অফিসার।
ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে খাচ্ছে!
প্রয়োজনে আরো অনেক কিছু ওরা করে।
কি বলছিস তুই।
ঠিক বলছি। ভেক না ধরলে ভিক্ষা পাওয়া যায় না।
সবাই চুপ। মুখ দিয়ে কারুর কোনো কথা বেরোচ্ছে না।
ওদের ইনফর্মেসনের ওপর তোরা বেঁচে আছিস। না হলে অনেকদিন আগে মরে হেজে যেতিস।
বড়মার দিকে তাকালাম। খেতে দাও।
ছোট জায়গাটা করে ফেল, ও অনেক্ষণ থেকে খেতে চাইছে।

ঘরে পা দিয়েই দেখলাম বিছানায় নতুন চাদর পাতা। বালিশের ওয়ারগুলোও নতুন লাগানো হয়েছে। বেশ ভালো লাগলো দেখে। চাদরের কালারটা এতো সুন্দর, মন ভরে গেলো। কিছুতেই বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে না। টান টান করে পাতা চাদরটার দিকে এক দৃষ্টে তাকালাম। বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। কাকা স্কুলফাইন্যাল পাশ করার পর একটা বেড কভার কিনে দিয়েছিলো। মনে পরে না কতদিন ওই বেড কভারে শুয়েছি।
টেবিলের ড্রয়ার খুলে মানিপার্টসটা থেকে আলমাড়ির চাবিটা নিলাম। জামাকাপরের পেছন থেকে পুরনো এ্যালবামটা বার করলাম। কাকা কলকাতায় আসার সময় এ্যালবামটা দিয়েছিলো। এতে আমার বাবা মা আমার কিছু ছবি আছে।
এই এ্যালবামে এবাড়ির কারুর হাত একনো পরে নি। সেদিন ফ্ল্যাট থেকে এটা নিয়ে এসেছিলাম।
পাতা উল্টে প্রথম ছবিটার দিকে তাকালাম। বাবা মা একসঙ্গে মায়ের কোলে আমি। এই একটা ছবি আমি বহুবার দেখেছি। তখন আমার বয়স আঠারো মাস। বাবা কলকাতায় এসেছিলেন স্কুলের কাজে। আমাকে মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। স্টুডিওতে তুলেছিলেন। মার খুব গঙ্গায় স্নান করার শখ ছিলো। পেছন দিকে স্টুডিওর স্ট্যাম্পটা এখনো রয়েছে। আলো স্টুডিও। এই এ্যাড্রেস ধরে ওখানে গেছি। স্টুডিও খুঁজে পাইনি তার জায়গায় একটা খাবার দোকান পেয়েছি। লোককে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে, যিনি ছবি তুলতেন সেই ভদ্রলোক মারা যেতে তারা ছেলেরা দোকান বিক্রি করে দিয়েছে।
চোখ বন্ধ করে বহুবার আমার এই আঠেরো মাস বয়সে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। বহুবার মায়ের কোলে বসে থাকার অনুভূতি পাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি। ছবিটা দেখলেই বুকটা ভীষণ টন টন করে, তাই দেখি না। আজ হঠাৎ কেনো দেখার ইচ্ছে হলো ? প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পেলাম না। একবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখলাম, একবার ছবির দিকে তাকিয়ে আমার মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মায়ের মুখের আদল আমার মুখশ্রীর সঙ্গে কিছুটা মেলে।
জানো মা তোমার ছেলে আজ তথাকথিত অনেক পয়সা ওয়ালা লোক। অনেক ক্ষমতা তার। লোকে ফিস ফাস করে। বলে রবিনহুড। একচ্যুয়েলি ওরা আমার মতো এতো ভ্যারাইটি লাইফ লিড করে নিতো। কিন্তু একান্ত নিজের বলতে তার কিছু নেই। শুধু বিদ্যেটুকু ছাড়া। এই পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্কের কোনো আত্মীয় আজও পর্যন্ত কাউকে পাই নি। তোমরা তার ক্লুও কোনোদিন রেখে যাও নি, যে খুঁজে বার করবো। তবে একনো আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের একটা শেকড় আছে। খালি আমার নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কলমকরা গাছ। ওই গাছ থেকে কেটে ঘষে মেজে এই গাছে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
বড়মা ছোটমা আমার জন্য যথেষ্ট করে। আমি তাদের ঋণ আমৃত্যু শোধ করতে পারবো না। এখন মাঝে মাঝে ভীষণ ভাবে তোমার কথা অনুভব করি। মিত্রা আমার মধ্যে অনেক কিছু দেখতে চায় বুঝলে মা। কিন্তু ওকে আমি কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনা, না পেতে পেতে আমার মনের সব আনন্দ গুলো শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। সেখানে এক সমুদ্র জলটাও নস্যি। 
 
 
 
 
 
 
Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks